ইরান-ইসরায়েলের ‘১২ দিনের যুদ্ধ’ থেমেছে, কিন্তু ফিলিস্তিনের গাজা উপত্যকার মানুষের ভাগ্য এখনো পরিবর্তন হয়নি। তবে সেই সম্ভাবনা নিয়ে আবারও আলোচনা শুরু হয়েছে। গাজায় নতুন যুদ্ধবিরতির জন্য মধ্যস্থতাকারীরা জোর প্রচেষ্টা চালাচ্ছেন বলে জানিয়েছে ফিলিস্তিনের স্বাধীনতাকামী সংগঠন হামসের এক কর্মকর্তা। এদিকে, ট্রাম্পের মধ্যপ্রাচ্য-বিষয়ক বিশেষ দূত স্টিভ উইটকফের দাবি, চুক্তির ‘খুব কাছাকাছি’ রয়েছে হামাস ও ইসরায়েল। এদিকে বুধবার সকালে ইসরায়েলের হামলায় আরো বেশ কয়েকজন ফিলিস্তিনি নাগরিক নিহতের খবর পাওয়া গেছে। তাদের অনেকেই ত্রাণ সংগ্রহের অপেক্ষায় ছিলেন বলে হামাস নিয়ন্ত্রিত গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের বরাতে জানিয়েছে ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম বিবিসি। অন্যদিকে মঙ্গলবার হামাসের দাবি করা বোমা হামলায় সাত ইসরায়েলি সেনা নিহত হয়েছে বলে জানিয়েছে ইসরায়েলি সেনাবাহিনী।
হামাস জানিয়েছে, গাজায় নতুন যুদ্ধবিরতি ও বন্দি ফেরতের বিষয়ে আলোচনা করতে তোড়জোড় করছেন মধ্যস্থতাকারীরা। তবে, এ বিষয়ে এখন পর্যন্ত ইসরায়েলের পক্ষ থেকে কোনো উত্তর পাওয়া যায়নি।
ইসরায়েল ও ইরানের ১২ দিনের যুদ্ধ শেষ হওয়ার পর মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প বলেছেন, ‘গাজা নিয়ে বড় অগ্রগতি হয়েছে’। ব্রাসেলসে সাংবাদিকদের ট্রাম্প বলেন, ‘আমাদের এই (ইরানের পারমাণবিক স্থাপনায়) আক্রমণের কারণেই গাজায় বড় অগ্রগতি হচ্ছে। আমি মনে করি আমরা শিগগিরই ভালো কিছু শুনতে পাব।
তিনি জানান, তার বিশেষ দূত স্টিভ উইটকফের সঙ্গে কথা হয়েছে এবং তিনি বলেছেন, ‘গাজায় সমঝোতা খুবই কাছাকাছি।’এর কিছুক্ষণ পরই হামাসের এক শীর্ষ কর্মকর্তা বিবিসিকে জানান, মধ্যস্থতাকারীরা যুদ্ধবিরতি নিয়ে জোরালো প্রচেষ্টা চালাচ্ছেন। তবে এখনও নতুন কোনো প্রস্তাব আসেনি বলে উল্লেখ করেন তিনি।
ইসরায়েলের এক কর্মকর্তা দেশটির সংবাদমাধ্যম হারেৎজকে জানিয়েছেন, আলোচনায় এখনও কোনো অগ্রগতি নেই এবং বড় ধরনের মতপার্থক্য রয়ে গেছে।
এর আগে, মে মাসের শেষ দিকে যুক্তরাষ্ট্র, কাতার ও মিসরের সমর্থনে ৬০ দিনের যুদ্ধবিরতির যে প্রস্তাব দেওয়া হয়েছিল, তাতে হামাস গ্রহণযোগ্য নয়—এমন কিছু সংশোধনী দাবি করলে আলোচনা স্থবির হয়ে যায়। ইসরায়েল ১৮ মার্চ গাজায় আবারও সামরিক অভিযান শুরু করে। বর্তমানে সেখানে অন্তত ৫০ জন ইসরায়েলি জিম্মি রয়েছে, যাদের মধ্যে কমপক্ষে ২০ জন জীবিত বলে ধারণা করা হচ্ছে।
সেই সঙ্গে মার্চের শুরু থেকে ইসরায়েল গাজায় সব ধরনের মানবিক সহায়তা প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা দেয়। তবে, আন্তর্জাতিক চাপের মুখে তিন মাস পর এটি আংশিক শিথিল করা হয়। এরপর ইসরায়েলের সমর্থনে যুক্তরাষ্ট্র নিয়ন্ত্রিত গাজা হিউম্যানিটারিয়ান ফাউন্ডেশন (জিএইচটি) নামে নতুন ত্রাণ বিতরণ কাঠামো চালু হয়েছে।
জিএইচটি দাবি করেছে, ২৬ মে থেকে এখন পর্যন্ত তারা ৪ কোটি ৪০ লাখের বেশি খাবারের প্যাকেজ বিতরণ করেছে। এমনকি, বুধবার ৩টি কেন্দ্রে ২৪ লাখের বেশি খাবারের প্যাকেট বিতরণ করা হয়েছে। নতুন এই ত্রাণ ব্যবস্থার সঙ্গে কাজ করতে অস্বীকৃতি জানিয়েছে জাতিসংঘসহ বেশ কয়েকটি মানবাধিকার সংস্থা। হামাসকে সহায়তা না দিয়ে ত্রাণ কার্যক্রম চালানোর এই বিষয়টিকে তারা মানবিক নীতিমালার পরিপন্থী বলে অভিহিত করেছে।
গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, জিএইচটি কার্যক্রম শুরুর পর থেকে ত্রাণ সংগ্রহের সময় ৫৪৯ জন নিহত এবং ৪ হাজার মানুষ আহত হয়েছেন। বুধবারও কেন্দ্রীয় গাজায় জিএইচটির একটি ত্রাণ বিতরণকেন্দ্রে ইসরায়েলি গুলিতে ছয়জন এবং দক্ষিণের রাফায় আরও তিনজন নিহত হয়েছে বলে জানিয়েছে হামাসের সিভিল ডিফেন্স। তবে ইসরায়েলি সেনাবাহিনীর দাবি, এসব ঘটনায় তারা কোনো হতাহতের খবর পায়নি।
ইউনিসেফের মুখপাত্র জেমস এল্ডার গাজা সফর শেষে বলেন, যতদিন মানুষকে খাবার থেকে বঞ্চিত করা হবে, তারা এই মৃত্যুফাঁদে যেতে বাধ্য হবে।
গাজায় ত্রাণ বিতরণ কেন্দ্রের কাছে গুলি, নিহত ৩৩
গাজায় আবারও ত্রাণ নিতে গিয়ে প্রাণ ঝরল ফিলিস্তিনিদের। ত্রাণ বিতরণ কেন্দ্র ও আশপাশের এলাকায় জড়ো হওয়া ক্ষুধার্ত গাজাবাসীর উপর গুলি চালিয়েছে ইসরায়েলি বাহিনী। এতে অন্তত ৩৩ জন নিহত হয়েছেন।
বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু বাহিনী গাজার বিভিন্ন এলাকায় হামলা অব্যাহত রাখলেও মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প বলছেন, উপত্যকায় যুদ্ধ বন্ধের বিষয়ে বড় অগ্রগতি হচ্ছে। কাতার জানিয়েছে, কয়েকদিনের মধ্যে পরোক্ষ আলোচনায় বসতে পারে ইসরাইল ও হামাস। আল জাজিরার প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বুধবার গাজাজুড়ে ইসরায়েলি হামলায় কমপক্ষে ৭৮ জন ফিলিস্তিনি নিহত হন। যাদের মধ্যে ৩৩ জনই ত্রাণ বিতরণ কেন্দ্রের কাছে অপেক্ষা করার সময় প্রাণ হারান।
স্থানীয় হাসপাতালগুলো বলছে, ত্রাণ নিতে যাওয়া মানুষদের লক্ষ্য করে হামলা অব্যাহত রয়েছে। গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় জানায়, গত ২৭ মে থেকে এ পর্যন্ত এমন হামলায় সাড়ে পাঁচশ’র বেশি ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন। জাতিসংঘ বলছে, এসব সহায়তা কেন্দ্র এখন মৃত্যুকেন্দ্রে রূপ নিয়েছে।
এদিন গাজায় ইসরায়েলি বিমান হামলায় ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয় বাসিন্দাদের আশ্রয় নেয়া ভবন। প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, কোনো আগাম সতর্কতা ছাড়াই ভবনটি গুঁড়িয়ে দেয় ইসরাইলি সেনারা। হামলায় ধসে যায় ভবনের ছাদ। নিচে চাপা পড়েন অনেকে। উদ্ধারকারীরা বলছেন, প্রয়োজনীয় সরঞ্জাম না থাকায় তারা হাতে খুঁড়েই মরদেহ উদ্ধারে বাধ্য হচ্ছেন।
এদিকে গাজায় মানবিক বিপর্যয়ের মধ্যেই কূটনৈতিক আলোচনায় গতি এসেছে। বুধবার কাতার জানায়, কয়েকদিনের মধ্যে পরোক্ষ আলোচনায় বসতে পারে ইসরায়েল ও হামাস। ফিলিস্তিনের স্বাধীনতাকামী সংগঠন জানিয়েছে, এ বিষয়ে কাতার ও মিসরের সঙ্গে আলোচনা চলছে, যদিও কোনো নতুন প্রস্তাব এখনও আসেনি।